ইসলামিক শাসনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শ
গণতন্ত্র এবং শরিয়া আইন কি একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? কোরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে কেন এই দুটি শাসন ব্যবস্থা আদর্শগত ভাবে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের আদর্শের পার্থক্য এবং ‘ইসলামিক গণতন্ত্র’ ধারণার সঠিক বাস্তবতা জানুন।
১. শাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা
-
ইসলামে:
- শাসন ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হলেন আল্লাহ।
- কোরআন বলে: "যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করে না, তারা কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।" (সূরা মায়েদা, ৫:৪৪)
-
গণতন্ত্রে:
- শাসন ক্ষমতা জনগণের হাতে, এবং আইন প্রণয়নের উৎস সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত।
- সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই চূড়ান্ত।
বিরোধ: ইসলামে শাসনব্যবস্থা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে, যেখানে গণতন্ত্রে জনগণই শাসন ক্ষমতার উৎস।
২. আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া
-
ইসলামে:
- আইন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তা অপরিবর্তনীয়।
- কোরআন বলে: "তবে কি তারা জাহিলিয়াতের শাসন চায়? আর যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য আল্লাহর শাসনের চেয়ে উত্তম শাসন আর কী হতে পারে?" (সূরা আল-মায়েদা, ৫:৫০)
- হাদীস: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: "তোমাদের মধ্যে কেউ আমার কোনো নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সে আমার অনুসারী হতে পারে না।" (সহীহ বোখারি )
-
গণতন্ত্রে:
- আইন মানুষের দ্বারা রচিত এবং পরিবর্তনযোগ্য।
- উদাহরণ: সংসদ সদস্য নতুন আইন প্রণয়ন বা পুরোনো আইন বাতিল করতে পারে।
বিরোধ: গণতন্ত্রে আইন মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তনযোগ্য, যা ইসলামের স্থায়ী আইন প্রণয়নের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩. নেতৃত্বের যোগ্যতা
-
ইসলামে:
- নেতৃত্বের যোগ্যতা হলো ঈমানদার হওয়া, ন্যায়পরায়ণতা, এবং আল্লাহর আইন মেনে চলা।
- কোরআন বলে: "নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন যে, তোমরা দায়িত্ব সমূহ তাদের কাছে পৌঁছে দাও যারা তার যোগ্য। এবং যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার করো, তখন ন্যায় নিষ্ঠতার সঙ্গে বিচার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে যা উপদেশ দেন, তা উত্তম। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।" (সূরা নিসা, ৪:৫৮)
- হাদীস: রাসূল (সা.) বলেছেন: "যদি নেতৃত্ব অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তবে কেয়ামতের দিন আসন্ন।"
-
গণতন্ত্রে:
- নেতৃত্ব যোগ্যতার চেয়ে জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
- একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারে, যদিও সে অনৈতিক বা অযোগ্য হয়।
বিরোধ: ইসলামে নেতৃত্ব যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল, গণতন্ত্রে জনপ্রিয়তার ওপর।
৪. সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বনাম আল্লাহর আইন
-
ইসলামে:
- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি আল্লাহর আইন অমান্য করে কোনো মতামত দেয়, তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
- কোরআন বলে: "যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কথা অনুসরণ করো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা কেবল ধারণা অনুসরণ করে এবং তারা কেবল অনুমানভিত্তিক কথা বলে।" (সূরা আনআম, ৬:১১৬)
-
গণতন্ত্রে:
- সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই চূড়ান্ত এবং আইন প্রণয়নে প্রধান।
বিরোধ: গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়, যা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।
“ইসলামিক গণতন্ত্র” ধারণার অসারতা: উদাহরণ ও যুক্তি
১. ইসলামের ইতিহাসে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি
- ইসলামের চার খলিফার যুগে (খিলাফত রাশেদা) আইন প্রণয়নের একমাত্র উৎস ছিল কোরআন ও সুন্নাহ।
- শাসকের নির্বাচন পরামর্শ (শুরা) বা সম্মতিতে হতো, তবে তা গণতন্ত্রের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে নয়।
উদাহরণ: আবু বকর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রাথমিকভাবে সাহাবিদের পরামর্শে। এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছিল না, বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে।
২. ইসলামিক আইন জনগণের মতামতের ঊর্ধ্বে
- শরিয়া আইন এমন কিছু বিষয় নিষিদ্ধ করে যা গণতন্ত্র বৈধ ঘোষণা করতে পারে।
- উদাহরণ: সুদ (রিবা) ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (সূরা বাকারা, ২:২৭৫), কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে এটি বৈধ।
৩. ইসলামিক রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের সামঞ্জস্যহীনতা
- ইসলামিক রাষ্ট্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
- গণতন্ত্রে রাষ্ট্র জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
- এই দুই ধারণা একসঙ্গে থাকতে পারে না।
কোরআন ও হাদীসের রেফারেন্স: “ইসলামিক গণতন্ত্র” ধারণার বিরোধিতা
-
শাসনের সার্বভৌমত্ব:
- "আল্লাহর হুকুম ছাড়া তাদের কোনো ফয়সালা করার অধিকার নেই।" (সূরা কাহফ, ১৮:২৬)
-
মানব রচিত আইন প্রত্যাখ্যান:
- "শাসন একমাত্র আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করো না।" (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)
-
গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি সতর্কতা:
- "যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কথা অনুসরণ করো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা কেবল ধারণা অনুসরণ করে এবং তারা অনুমানভিত্তিক কথা বলে।" (সূরা আনআম, ৬:১১৬)
উপসংহার: ইসলামে গণতন্ত্রের কোন স্থান নেই।
- কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে স্পষ্ট যে, ইসলামে শাসনব্যবস্থা আল্লাহর আইন মেনে চলে। জনগণের মতামত এখানে আল্লাহর বিধানের অধীন।
- “ইসলামিক গণতন্ত্র” ধারণা কোরআন বা সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি মূলত একটি রাজনৈতিক প্রচারণা।
- ইসলামের শাসনব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনীয়। এটি কোনো মানব রচিত গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলে না।
What's Your Reaction?